দেশের উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী বেসরকারী ডিগ্রী কলেজ দিনাজপুর শহরের দক্ষীন উপকন্ঠে ঐতিহাসিক রামসাগর দীঘির যাত্রাপথের ধারে ১৫ একরে বিস্তৃত এক মনরম পরিবেশে অবস্থিত। কোতয়ালী থানার ৬ নং আউলিয়া পুর ইউনিয়নের মামুদপুর মৌজায় কলেজের অধিক অংশের অবস্থান। দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী বেদনা লিচুর উৎপাদন স্থল মাশিমপুর গ্রামের অবস্থান কলেজের পাশঘেষে। দিনাজপুর জেলার প্রথম মোসলমান আইনজীবী ও পাকিস্থান আন্দোলনের এই অঞ্চলের পুরোধা মরহুম কাদেরবক্স-এর নামে ১৯৬৮ সালে বর্তমান স্থলে কলেজটি চালু হয়।
দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী এস এন কলেজ সুইহারীতে স্থানান্তরিত হয়ে দিনাজপুর কলেজ এবং পরবর্তীতে কলেজটি সরকারী হয়ে সীমিত আসন সংখ্যা হওয়ার প্রেক্ষিতে বর্তমান স্থানে কে,বি,এম কলেজ স্থাপনের রূপকার তৎকালীন চেরাডাঙ্গী কলেজের অধ্যক্ষ ও জেলার বিশিষ্ঠ শিক্ষাবিদ জনাব মাহমুদ মোকাররম হোসেন চেরাডাঙ্গী কলেজটি শহরের দিকে স্থানান্তরিত করে বর্তমান স্থানে প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব প্রদান করেন। তাঁকে বলিষ্ঠ সমর্থন দিয়েছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব আ কা ম যাকারিয়া যিনি কলেজের জন্য ১৫ একর জমি অধীগ্রহণ করে দেন এবং সহযোগিতা দিয়েছিলেন তৎকালীন চেরাডাঙ্গী কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ মরহুম ফজলে হক, মরহুম আলহাজ্ব লতিফর রহমান, মরহুম পশরউদ্দীন আহমদ, মরহুম আলহাজ্ব তিনকোড় মোহাম্মদ, মরহুম শাহ আজিজার রহমান, মরহুম আব্বাস উদ্দীন আহমদ, জনাব মঈনুদ্দীন আহমদ চৌধুরী, আলহাজ্ব সফিঊদ্দীন আহমদ, জনাব মাকসুদ আলী, জনাব মোঃ আব্দুস সালাম প্রমুখ সহ বিশিষ্ট শিল্পপতি মরহুম আজিজুল হক চৌধুরী এবং জনাব খায়রুল আনম।
চেরাডাঙ্গীতে একটি কলেজ স্থাপনের জন্য সেইদিন ঐ এলাকার সামাজিক নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হোসেনের আহবানে সাড়া দিয়ে যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, বলিষ্ট ভুমিকা রেখেছেন জেলার তথা দেশের উত্তরাঞ্চলের শিক্ষা সম্প্রসারণের ইতিহাসে তা এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে ভাস্বর হয়ে থাকবে। এই উপলক্ষে ৬ জুন, ১৯৬৫ সালে চেরাডাঙ্গী হাই স্কুলের সেক্রেটারী এবং চেরাডাঙ্গী মেলে কমিটির সেক্রেটারী জনাব মোকাররম হোসেনের আহবানে এলাকার সর্বশ্রেণীর নেতৃবৃন্দের এক সভায় চেরাডাঙ্গী কলেজ প্রতিষ্টার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
যেহেতু চেরাডাঙ্গী কলেজের ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক থেকে শুরু করে চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ এবং টাকা-পয়সা সহ শুরু হয়েছিল কে, বি, এম কলেজের যাত্রা তাই চেরাডাঙ্গী কলেজের স্থাপনা বর্স ১৯৬৫-৬৬ শিক্ষা বর্সকেই কে, বি, এম কলেজের প্রতিষ্টা বৎসর ধরা হয়। তখন চেরাডাঙ্গী কলেজের অধ্যক্ষ ও বাংলার অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেছিলেন জনাব মোকাররম হোসেন, ইংরেজীর অধ্যাপক হিসাবে জনাব মরহুম রমজান আলী, ইসলামের ইতিহাসের অধ্যাপক হিসাবে জনাব মতাহার হোসেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসাবে জনাব মজনুর রাহমান এবং অর্থনীতির অধ্যাপক হিসাবে জনাব মোঃ সাইফুদ্দীন। ১৯৬৮-৬৯ শিক্ষাবর্স থেকে বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হওয়ার সময় থেকে কলেজে আর্টস ও কমার্স বিষয়ে স্নাতক এবং উচ্চমধ্যমিক ক্লাস শুরু করে কলেজটি ১৯৭৪ সাল থেকে পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রী কলেজ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। কে, বি, এম কলেজের প্রথম পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব আ কা ম যাকারিয়া, সম্পাদক জনাব খায়রুল আনম এবং কোষাধ্যক্ষ মরহুম আজিজুল হক চৌধুরী ।
কলেজের লাল টিনসেড এবং লাল বিল্ডিং অংশ ১৯৬৮ সালে তড়িঘড়ি করে নির্মাণ করে সেখানেই শুরু হয় কে, বি, এম কলেজের কর্মকান্ড। লাল বিল্ডিং অংশের তিনটি কক্ষ বর্তমান শিক্ষক বিরামাগার, ছাত্রী বিরামাগার এবং অফিস কক্ষ সেই সময় পদার্থ, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানের ল্যাবরেটরী হিসাবে ব্যবহৃত হয় । বর্তমান নামাজ ও ছাত্র সংসদ কক্ষ দুইটি ছিল একটি কক্ষ – যার দক্ষিণ অংশে একটি হাফ পার্টিশন কক্ষে বসতেন অধ্যক্ষ সাহেব, আর বড় অংশে শিক্ষকবৃন্দ ।
বর্তমান বিজ্ঞান ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৯৬৯-৭০ সালে, সরকারী উন্নয়ন স্কীমের অর্থে ডিপি আই-এর মাধ্যমে। সবাধীনতার পর ১৯৭২ সালে আরডি আর এস এবং রাজশাহী বিভাগ উন্নয়ন বোর্ডের অর্থানুকুলে বিজ্ঞান ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। পদার্থ, রসায়ন এবং উদ্ভীদ বিজ্ঞানাগারের স্থান সংকুলান হয় সেখানে। অধ্যক্ষ কক্ষ, অফিস, শিক্ষক বিরামাগার স্থানান্তর হয় বর্তমান স্থানে, শিক্ষক বিরামাগার কক্ষ সংলগ্ন ছোট কক্ষটিতে স্থাপিত হয় কলেজ লাইব্রেরী। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার পশ্চীমাংশ নির্মান করে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগকে স্থানান্তর করা হয় সেইসাথে বিশাল কলেজ লাইব্রেরী, প্রানীবিজ্ঞান বিভাগ এবং গণিত বিভাগ স্থাপন করা হয়। ২০১০ সালে বিজ্ঞান ভবনের তৃতীয় তলার বাঁকি অংশের কাজ সম্পন্ন করে কৃষি ডিপ্লমা কোর্স স্থাপন করা হয় । বর্তমানে ভবনটির চতুর্থ তলার কাজ এবং দক্ষিন দিকে বিশাল বারান্দার কাজ প্রায় শেষ। আশা করছি কয়েকটি অনার্স বিভাগকে এখানে স্থাপন করা সম্ভব হবে।
কলেজের ছাত্রাবাসটি নির্মিত হয় ১৯৭৭ সালে । ছাত্র সংসদের অব্যাহত দাবী এবং প্রাথমিকভাবে ছাত্র-সংসদের অব্যবহৃত অর্থে ১৯৮৮ সালে নির্মিত হয় কলেজের মিলনায়তন যার নীল নকশা অনুযায়ী মঞ্চ, ছাত্র সংসদ অফিস ও পোর্টিকোট নির্মাণ এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে । এই নির্মানে বাইরের কোন অর্থ সাহায্য ছিল না । তেমনি ১৯৮৯ সালে বিজ্ঞান ভবনের সিড়ির পশ্চিমাংশের দোতালা অংশ নির্মান করা হয় ১০০ ভাগ কলেজ তহবিল দিয়ে । শিক্ষা ফ্যসিলিটিজ বিভাগের দ্বারা নির্মিত হয় ভবনের সিড়ির পূর্ব অংশের দোতালা এবং পশ্চিম অংশের তিন তলা ১৯৯৩ সালে । সরকারী সহায়তা না পাওয়ায় সম্পূর্ণ স্বর্থায়নে বিজ্ঞান ভবনের বাকী অংশ, বিজ্ঞান বভবনের স্যানিটারী ও বৈদ্যুতীকরণের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা হয় । ১৯৯৩-৯৪ অর্থ বছরে সম্পূর্ণ স্বর্থায়নে কলেজের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজ সম্পন্নের মধ্যদিয়ে কেবিএম কলেজ বর্তমানে এই সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য লাভ করে । কেবিএম কলেজে কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছেন ইংরেজী বিভাগের অধ্যপক রমজান আলী ১৯৭৮ সালে, বানিজ্য বিভাগের অধ্যাপক ওসমান গনী ১৯৯৪ সালে, ক্যাশিয়ার জনাব ছাদেক আলী ১৯৯৫ সালে, পিওন মজিবর রাহমান ১৯৮৯ সালে, রমজান আলী ১৯৮৭ সালে এবং ইসমাইল হসেন ১৯৯১ সালে ।
১৯৬৫ থেকে ২০১৭ এই দীর্ঘ ৫৩ বছর চেরাডাঙ্গী কলেজ থেকে শুরু করে বর্তমানের কেবিএম কলেজ – এই দীর্ঘ উত্তরনের ইতিহাস কেবিএম কলেজের পর্যায়ক্রমিক অগ্রগতির ইতিহাস । অধ্যক্ষ মাহমুদ মোকাররম হসেনের যোগ্য নেতৃত্ব এবং শিক্ষক বৃন্দের অবিরাম প্রচেষ্টা, স্থানীয় এবং শহরের গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গের সুকামনা এবং প্রবাহমান ছাত্র-ছাত্রীদের সহযোগীতায় কেবিএম কলেজ আজ দেশের একটি সুপরিচিত বৃহৎ বেসরকারী ডিগ্রী কলেজ । ১৯৯৪-৯৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে কলেজে উচ্চমাধ্যমিক মানবিক শ্রেণীতে বাংলা, ইংরেজী, ইসলামের ইতিহাস, অর্থনিতী, পৌরনিতী, কৃষি বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়, বানিজ্য শ্রেণীতে সকল বিষয় এবং বিজ্ঞান শ্রেণীতে পদার্থ, রসায়ন, জীব বিজ্ঞান, গনিত, আইসিটি এবং কৃষি শিক্ষা বিষয়ে পাঠ গ্রহনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে । স্নাতক বি বি এস এবং বি এস এস স্রেণী সমুহে বাংলা, ইংরেজী, ইসলামের ইতিহাস, অর্থনিতী, রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়, বানিজ্য শ্রেণীতে সকল বিষয় এবং বিজ্ঞান শ্রেণীতে পদার্থ, রসায়ন, জীব বিজ্ঞান এবং গনিত বিষয়ে পাঠ গ্রহনের সুবিধা আছে । কলেজে বাংলা, ইংরেজী, ইসলামের ইতিহাস, অর্থনিতী, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান বিষয়, উদ্ভীদ বিদ্যা, প্রাণী বিদ্যা, ব্যবস্থাপনা, হিসাব বিজ্ঞান এবং বি বি এ সহ মোট ১১টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু আছে । আগামীতে পদার্থ, রসায়ন ও গনিত বিষয়ে অনার্স কোর্স নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ।
ছাত্র বেতন ছাড়াও কলেজের বাগানের ফল ফলাদি এবং পুকুরের মৎস্য চাষ করে কলেজের আর্থিক প্রাপ্তি ঘটে ।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙ্গালী জাতীর এক গৌরবময় অধ্যায় । এই মুক্তিযুদ্ধের সহিত কেবিএম কলেজের একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কেবিএম কলেজে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল যেখান থেকে পরিকল্পনা করে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনির মোকাবেলা করত । এক পর্যায়ে হানাদার বাহীনিদের হামলায় কলেজের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায় । পরবর্তিকালে সরকার কলেজের ক্ষতি পুরুনে আর্থিক সহয়তা প্রদান করে । সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বর্তমান কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জনাব ইকবালুর রহিম –এর উদ্যোগে কলেজের মূল ফটকের উভয় পার্শে পাথরে খচিত মুক্তিযুদ্ধের মূরাল স্থাপন করে কলেজকে গৌরবউজ্বল করেছে ।
Home » প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে